আড়ি! জনমের আড়ি!
।। নাসীমুল বারী ।।
রিফ আর রাদিয়া।
ওদের আরো বন্ধু আছে। ওরা হলো আতিফা, শাফি, আনাস, আবিদ, সাদাব, জাবির, জুবায়ের, সাদ ও বিসর্গ। সবার বড়ো রিফ। গ্রামের বাড়িতে ওরা বেড়াতে এসেছে।
দু’দিন আগে দক্ষিণের ওই তেপান্তরের মাঠে যাদুর শিং পেয়ে জাদুর রাজ্যে গিয়েছিল ওরা। সে যে কি মজা ছিল!
আজও আনন্দ করবে। মজা করবে। আরেক মজা। চড়ুইভাতির মজা। সবাই চড়ুইভাতি খেলবে বাড়ির দক্ষিণ পাশের বড় বনটায়।
চাঁদা তুলে চাল ডাল যোগাড় করেছে। হই চই করতে করতে সবাই বনে চলে আসে।
কিন্তু বনে এসে পড়েছে মহাবিপদে। লাকড়ি পাবে কই? শুকনো ডাল তো সব বড় বড় গাছে। ওরা ছোট। কেউ গাছে চড়তে পারে না। মন খারাপ করে ভাবছে কী করবে। এমন সময় একটা বানর এসে বলে, আমাকে খেলায় নিলে আমি শুকনো লাকড়ি যোগাড় করে দেব।
রিফ খুশি হয়ে বলে, ঠিক আছে। তবে তুমি কিন্তু আমাদের সাথে দুষ্টুমী করতে পারবে না।
-না, আমি কিচ্ছু করব না।
এমন সময় লাল তেলতেলে একটা বনমুরগী এসে বলে, আমাকে খেলায় নিলে আমি তোমাদের অনেকগুলো ডিম দেব। মজা করে খেতে পারবে।
বনমুরগীর কথা শুনে জাবির খুশিতে লাফিয়ে বলে, আমি বল ডিম খাব।
অমনি অট্টহাসি দিয়ে শাফি বলে, ডিম তো বলের মতোই হয়। জাবির কেমন কথা বলল রে!
শাফির কথায় রিফ বলে, বল মানে বয়েল ডিম; সিদ্ধ ডিম, বুঝলে?
এবার আরো জোরে হেসে দেয় সবাই।
ঠিক তখনি সেখানে আসে একটা মেটে রঙের ভোঁদর। রিফের কাছে গিয়ে বলে, আমাকে খেলায় নিলে আমি বনের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে দেব। একটা দোয়েল ঝুপ করে পাশের ছোট্ট ডালটায় বসে বলে, আমাকে খেলায় নিলে আমি তোমাদের গান শোনাব।
খুশি হয়ে ওরা সবাই বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে সবাইকে খেলায় নেব।
ওরা বনের মধ্যখানের পলাশতলায় চড়ুইভাতির আয়োজন করে। পলাশ গাছটা বলে, বা রে! তোমরা আমার নিচে খেলবে, আর আমারে নিবে না?
-হ্যাঁ নেব।
-আমিও তোমদের লাল টুকটুকে ফুল দেব।
-কী মজাই না হবে!
খুশিতে সবাই বলে ওঠে।
এদিকে লাকড়ি যোগাড় করতে বানর গাছে গাছে ঘোরে। হঠাৎ একবার লাফ দিতে গিয়ে ডাল ধরতে পারে নি বানরটা। মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। ভয়ে ওরা জড়সড়। আচমকা অন্য একটা ডাল ধরে রক্ষা পায়। ভয় কাটিয়ে খুশি হয় সবাই। এমন সময় পুকুরে ঝুপ করে একটা আওয়াজ হল। সেদিকে তাকায় ওরা। দেখে ভোঁদরটা বড় একটা রুই মাছের সাথে লড়াই করছে। জাবিররা সবাই খুশিতে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে।
ভোঁদর বনের পুকুর থেকে বড় দু’টি রুই মাছ ধরে আনে আর বানর আনে অনেক লাকড়ি। জাবির আর আনাস যায় বনমুরগীর সাথে ওর বাসায়। পুকুরপাড়ের এক ঝোঁপের মধ্যে খড়কুটো দিয়ে বানানো তুলতুলে ছোট্ট বাসা। ওর মধ্যে অনেকগুলো ডিম। তা দেখে ওরা দু’জন খুশি হয়ে যায়। আনাস দৌড়ে গিয়ে জুবায়ের, সাদাব ও বিসর্গকে নিয়ে আসে। সবাই মিলে ডিম আনে ওখান থেকে।
রিফ, রাদিয়া, আতিফা ও বিসর্গ রান্নায় বসে গেছে। লাকড়ির রান্না-ধোয়ার জ্বালায় চোখে পানি এসে গেছে। অন্যরা খেলছে। খেলার মাঝেই দৌড়ে এসে আনাস আর সাদাব বলে, ওখানে একটা হাতি নাচছে। চলো দেখে আসি।
সবাই দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে কিচ্ছু নেই।
অমনি আনাস আর সাদাব হো হো করে হেসে দিয়ে বলে, ঠকা খেয়েছে, কী মজা!
অন্যরা লজ্জায় কিছু বলে না।
রান্না শেষ। এবার খাবার পালা। শাফি বলে, সালাদ হলে ভালো হতো। আমি সালাদ পছন্দ করি।
সাথে সাথে সাদ বলে, বনের পাশের ক্ষেতটায় আমি টমেটো দেখেছি। চলো ওখান থেকে টমেটো নিয়ে আসি।
অমনি শাফি, সাদ ও আনাস যায় ওখানে। গিয়ে দেখে লাল টকটকে টমেটো। পাশের আরেকটা ক্ষেতে শসা। ওরা খুশিতে আটখানা। অনেক শসা-টমেটো তুলে নিয়ে আসে।
খাবারের সময় শীতল পাটিটা বিছিয়ে খেতে বসে। এ পাটিটা ওরা আগেই সাথে এনেছিল। ভোঁদরটাকে পাশের বকুলতলায় খেতে দেয়া হয়েছে। ওটার খাবার হলো কাঁচা মাছ আর মাছের মাথাগুলো। বানর কলাপাতা নিয়ে এসেছে। তাতে দেয়া হয় আস্ত শসা, টমেটো আর অল্প কিছু পোলাও। মোরগ আর দোয়েলকে ঘাসের উপর একটা জায়গায় দেয়া হয় পোলাও।
সবাই মজা করে খায়।
খাওয়া শেষে গানের আসর। জাবিরকে গান গাইতে বললে ও বলে, আমার লজ্জা লাগে।
জাবিরের কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। জাবির রাগ করে। রাদিয়া বলে, শোন জাবির, একসাথে কোথাও গেলে কথা শুনতে হয়। রাগ করলে সবাই তো হাসবে, ক্ষেপাবে। খারাপও ভাববে।
পলাশের ডালটায় বসে ছিল দোয়েল। দোয়েলটা বলে, আমি তাহলে তোমাদের গান শোনাই, কেমন?
বিসর্গ বলে, আচ্ছা তাই হবে, তাই হবে।
এমন সময় পলাশ গাছটা একটু নড়ে ওঠে। তারপর ডাল নুইয়ে পলাশ বলে, দোয়েল, তুমি গান শোনাবে না। একদম না।
একটু চমকে রিফ্ পলাশ গাছকে জিজ্ঞেস করে, তুমিও তো আমাদের সাথে আছ। এখন আবার গান শোনাতে বারণ করছ কেন? রাগ করেছ বুঝি?
-তোমরা ভালো না, পঁ-চা- – -। তাই।
খুব চমকে সবাই সমস্বরে বলে ওঠে- কেন? কেন?
-তোমরা ভালোও না, সুন্দরও না।
-কেন?
-আনাস আর সাদাব হাতি দেখানোর কথা বলে মিথ্যা কথা বলেছে। তোমরা মানুষেরা মিথ্যা কথা বল। আরেকজনের ক্ষেত থেকে না বলে টমেটো আর শসা নিয়ে এসেছে। না বলে কারো কিছু নিয়ে গেলে কী হয় জানো?
-কী হয়?
রিফ জিজ্ঞেস করে।
-না বলে কিছু নেওয়া চুরি। চোররা কি ভালো হয়? তোমরা চুরি করেছ, মিথ্যা কথা বলেছ। লেখাপড়া শিখেও তোমরা এখন খারাপ কাজ করছ। আড়ি! আড়ি! তোমাদের সাথে জনমের আড়ি! আ- -র কথা বলব না।
সে থেকে গাছেরা আর কোন কথা বলে না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে।
(৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)
~নাসীমুল বারী